নিউইয়র্কের কুইন্স হাসপাতালে বাংলাদেশী আমেরিকান জিহানের আঁকা বিশাল ম্যুরাল
নিউজ২৪ইউএসএ.কম ডেস্ক, নিউইয়র্ক : নিউইয়র্ক সিটি হেলথ এন্ড হসপিটাল বিভাগের কুইন্স হাসপাতালে বিশালকায় একটি ম্যুরাল এঁকেছেন বাংলাদেশী আমেরিকান তরুণ শিল্পী জিহান ওয়াজেদ। গত ১৫ নভেম্বর দুপুরে ছিলো বারো’শ পঞ্চাশ বর্গফুটের ‘রুটস অফ মেডিসিন’ ম্যুরালটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন। কুইন্স হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী নেইল জে মুর ও জিহান ওয়াজেদ যৌথভাবে ফিতা কেটে উন্মোচন করেন ম্যুরালটি। এনওয়াইসি হেলথ এন্ড হসপিটাল বিভাগের তথ্য মতে আমেরিকার পাবলিক হাসপাতালের কমিউনিটি ম্যুরাল প্রকল্পের মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড় ম্যুরাল। ফিতা কাটা পর্বের আগে মেইন হসপিটাল এট্রিয়ামে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে হাসপাতালের কর্মকর্তাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কুইন্স হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী নেইল মুর, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ডাঃ এরিক ওয়েই, এসিসস্ট্যান্ট ভাইস চেয়ারম্যান রিক লুফটগ্লাস, কুইন্স হসপিটাল কমিউনিটি বোর্ড চেয়ারম্যান রবিন হোগানস, কুইন্স মেডিকেল নির্বাহী কমিটির পরিচালক ডাঃ মার্সি স্টেইন এলবার্ট ও শিল্পী জিহান ওয়াজেদ।
জ্যামাইকার কুইন্স হসপিটালের মূল প্রবেশপথের ডানে প্রথম ও দ্বিতীয় তলা মিলে প্রশস্ত লবির দেয়ালে বিশালাকৃতির ম্যুরালটি হাসপাতালের সৌন্দর্য্য বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। নিউইয়র্ক সিটির হেলথ অ্যান্ড হাসপাতাল বিভাগ ১৯৩০ সাল থেকে সিটির হাসপাতালগুলোতে ম্যুরাল ও চিত্র স্থাপনের জন্য ‘কমিউনিটি ম্যুরাল প্রজেক্ট’ গ্রহণ করেছে এবং এর আওতায় জিহানের এ ম্যুরালটি স্থাপন করা হয়েছে। সিটির হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ‘আর্টস ইন মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট’ এ প্রজেক্টের দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত। কুইন্স হাসপাতালে জিহানের ম্যুরালের জন্য আর্থিক সহায়তা দিয়েছে লোরি এম. টিশ ইল্যুসিনেশন ফান্ড। ম্যুরালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে প্রতিষ্ঠানটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর রিক লাফটগ্লাস ম্যুরাল সম্পর্কে বলেছেন যে, ম্যুরালটি কুইন্স হাসপাতালের আকর্ষণ বাড়িয়ে দিয়েছে। শিল্পকর্মের মাধ্যমে রোগী ও পরিবারের সদস্যদের মনে প্রশান্তি আনার প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের উদ্যোগে অংশগ্রহণ করতে পেরে আমরা গর্ব অনুভব করছি।
অনুষ্ঠানে শিল্পী জিহান ওয়াজেদ বলেন, আমি এই হাসপাতাল থেকে মাত্র কয়েক ব্লক দূরে বেড়ে উঠেছি। কুইন্স হাসপাতালের দেয়ালে ম্যুরাল আঁকতে পেরে আমার ভালো লাগছে। জিহান বলেন, কৈশোরে আমার একটি আঙুল ভেঙে গেলে আমার বাবা আমাকে এই হাসপাতালের জরুরী বিভাগে এনেছিলেন। আমার আঙুল সেরে ওঠে। সেই আঙুল দিয়েই আমি আজকের এই ম্যুরাল এঁকেছি। তিনি বলেন, আমি ৮টি ফুলের বৈচিত্র্য তুলে ধরেছি ম্যুরালে। যার মধ্যে প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে এই হাসপাতালে আসা নানা কম্যুনিটির মানুষদের । আর গাছের লতাপাতার মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছি এত বৈচিত্র সত্ত্বেও আমরা পরস্পর কত ঐক্যবদ্ধ। তিনি নিউইয়র্ক সিটি হেলথ এন্ড হসপিটাল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান তাকে এধরনের একটি কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। সিটি হাসপাতালের আর্টস ইন মেডিসিন প্রোগ্রামের অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট লারিসা ট্রিন্ডার বলেন, জিহানের ম্যুরাল একটি বৃহৎ আকারের অভিজ্ঞতা যা কুইন্স হাসপাতালের ব্যস্ত লবির মধ্যে প্রকৃতিকে নিয়ে এসেছে বাস্তবে। ম্যুরালে জীববৈচিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে যা মানুষের রোগ নিরাময়ে ভূমিকা রাখে এবং প্রশান্তি আনে রোগীর মনে। আমরা জনস্বাস্থ্যের উপর ইতিবাচক প্রভাবের জন্য ম্যুরালগুলিকে স্বাস্থ্যসেবার একটি পরিষেবা হিসাবে বিবেচনা করি। তিনি বলেন, আজ গর্বিত বোধ করছি কুইন্স কমিউনিটির কাছে ম্যুরালটি স্থাপন করতে পেরে ।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতে ‘রুটস অফ মেডিসিন’ বা ‘ওষুধের মূল’ হলো আটটি ফুল Ñ ক্যালেন্ডুলা, ল্যাভেন্ডার, ক্যামোমাইল, ইচিনেসিয়া, তিসি (ফ্ল্যাক্স সিড), গোলাপের পাপড়ি, সেন্ট জনস ওয়ার্ট এবং কলমি ফুল (ন্যাস্টার্টিয়াম)। এগুলোর মধ্যে ল্যাভেন্ডার অস্থিরতায় প্রশান্তি ও অবসাদ আনতে; ক্যামোমাইল হজমে সহায়তা করতে; ক্যালেন্ডুলা প্রদাহ ও ক্ষত-নিরাময়ে; ইচিনেসিয়া রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধিতে; তিসি বীজ হৃদপি-কে ঠিক রাখতে ও হজমে সহায়তা করতে; গোলাপের পাপড়ি প্রশান্তি আনতে; সেন্ট জনস ওয়ার্ট বিষন্নতা দূর করতে ও উদ্বেগ প্রশমনে এবং সর্বোপরি কলমি ফুল বা ন্যাস্টার্টিয়াম ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক।’ জ্যামাইকার কুইন্স হসপিটাল সেন্টারের সৌন্দর্য বিকাশে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত তরুণ শিল্পী জিহান ওয়াজেদের আঁকা ম্যুরালে ‘রুটস অফ মেডিসিন’গুলো অলঙ্কৃত হয়েছে। এ ম্যুরালের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের সময় রোগ নিরাময়ের সঙ্গে প্রকৃতি এবং মানুষের দৈহিক ও মানসিক সম্পর্কের নিবিড়তার কথাগুলো উঠে আসে আলোচনায়।
উল্লেখ্য, সিটির হেলথ অ্যান্ড হাসপাতাল বিভাগ শিল্পী জিহানকে গত এপ্রিল মাসে ম্যুরাল আঁকার জন্য নির্বাচিত করে। এ উদ্দেশ্যে প্রাথমিক চুক্তিপত্র সম্পন্ন হলে গত ২ আগস্ট কুইন্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আয়োজন করেছিল কমিউনিটি ম্যুরাল পেইন্ট পার্টির । উল্লেখ্য, সিটির হেলথ এন্ড হসপিটালস নিউইয়র্ক সিটির সবচেয়ে বৃহৎ শিল্প সংগ্রাহক হিসেবেও সমাদৃত। শিল্পকর্ম সংগ্রহের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এই কাজগুলো এক নিরাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে, দৃষ্টিসুখের সৃষ্টি করে। কমিউনিটি ম্যুরাল প্রকল্প হাসপাতালের সিটির নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের বিকাশেও অবদান রাখে বলে প্রকল্পটি ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উল্লেখ্য, সিটির হেলথ এন্ড হসপিটালস নিউইয়র্ক সিটির সবচেয়ে বৃহৎ শিল্প সংগ্রাহক হিসেবেও সমাদৃত, যাদের সংগ্রহে ৭,০০০ এর অধিক শিল্পকর্ম রয়েছে এবং কোনো কোনো ঐতিহাসিক ম্যুরালের জন্য খ্যাতনামা শিল্পীদের কমিশন করা হয়েছে। এ প্রকল্প শুরু হয়েছিল ১৯৩০ এর দশকে ওয়ার্কস প্রগ্রেস প্রশাসনের আওতায় এবং এ প্রকল্পের অধীনে হাসপাতালগুলোতে স্থাপিত হয়েছে শিল্পকর্ম, মোজাইক, আলোকচিত্র, স্থাপত্য, ম্যুরাল। এসব কর্মে অবদান রেখেছেন আমেরিকার বহু নেতৃস্থানীয় শিল্পী, যাদের অন্যতম জ্যাকব লরেন্স, বোমারে বিয়ারডন, হেলেন ফ্রাঙ্কেনথালের, ম্যারি ফ্র্যাঙ্ক, বেটি ব্লেটন, ক্যানিডা আলভারেজ প্রমুখ। শিল্পকর্ম সংগ্রহের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এই কাজগুলো এক নিরাময় পরিবেশ সৃষ্টি করে, দৃষ্টিসুখের সৃষ্টি করে। সিটি হেলথ এন্ড হসপিটালস এর সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও চিফ কোয়ালিটি অফিসার এরিক ওয়ে, এমডি বলেছেন, আমাদের রোগী, তাদের পরিবার এবং আমাদের কর্মীদের নিরাময় সংস্কৃতিতে উৎসাহিত করার কৌশল হিসেবে আমরা শিল্পকর্মগুলোকে করিডোর, ক্লিনিক ও স্টাফদের বিচরণের জায়গায় স্থাপন করি, যা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। সিটির হাসপাতালগুলোতে চলতি বছর যে নয়টি নতুন ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে, কুইন্স হাসপাতালে জিহানের ‘রুটস অফ মেডিসিন’ তার অন্যতম।
জিহান ওয়াজেদ এর আগেও সিটির বিভিন্ন স্থানে ম্যুরাল অঙ্কন করেছেন। কুইন্স হাসপাতাল ছাড়াও সম্প্রতি জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টের টার্মিনাল-৪ এ একটি ম্যুরাল এঁকেছেন জিহান ওয়াজেদ। শ্রীঘ্রই ম্যুরালটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবে জেএফকে এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ। নিউইয়র্ক সিটির এস্টোরিয়ার ই্স্ট রিভার তীরে ‘এ সিটি ইন মোশন’ নামে একটি ম্যুরাল এঁকেছেন জিহান। হল্টারস পয়েন্ট মেগা ডেভেলপমেন্টে ৭৫০ ফুটের এই ম্যুরালটির স্থিরচিত্র সচল হয়ে উঠে মোবাইল অ্যাপসে। আকর্ষনীয় ম্যুরালটি দৃষ্টি কেড়েছে এলাকাবাসীর। তার অন্যতম শিল্প কর্মের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবন, নিউইয়র্ক ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টস কমপ্লেক্স, বিলি জিন কিং ন্যাশনাল টেনিস সেন্টার, এস্টোরিয়ায় ১৭৭ ফিট দীর্ঘ ম্যুরাল ‘ওয়েলকাম এস্টোরিয়া’ মুর্যাল এবং সিটিতে বাংলাদেশিদের প্রাণকেন্দ্র জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় ‘বাংলাদেশ ম্যুরাল’ অন্যতম। নিউইয়র্ক সিটিতে এইভাবেই জিহান বাংলাদেশীদের গর্বিত করে চলেছেন। এছাড়া নিউইয়র্ক সিটির বিভিন্ন বরোতে বড় বড় মুরাল্য অঙ্কণ করেছেন জিহান ওয়াজেদ। মুর্যাল ছাড়াও নিউইয়র্কে ম্যানহাটানস্থ গ্যালারীতে তার বেশ কয়েকটি একক চিত্র প্রদর্শনী ব্যাপক সাড়া জাগায় মুলধারার দর্শকের মাঝে। স্টুডিওতে ছবি আঁকার পাশাপাশি তার নিজস্ব স্টাইলে ম্যুরাল আঁকছেন দেয়ালে। তার ম্যুরালের রয়েছে নিজস্ব ও নূতন ধারা। তার স্টুডিও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে। তিনি সাপ্তাহিক বাংলাদেশ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদ খানের পুত্র।