নিউজ২৪ইউএসএ.কম : নিউইয়র্কে চেস্টনাট রিজে প্রথমবারের মত অনুষ্ঠিত হয়েছে বেঙ্গলি ইন্টারন্যাশনাল লিটারারী সোসাইটির রকল্যান্ড রিট্রিট অ্যান্ড বুক ফেয়ার। মেলাকে ঘিরে লেখক-প্রকাশক-কবি-সাহিত্যিকের পদভারে মুখরিত ছিল সবুজে ঘেরা মনোরম পরিবেশের চেস্টনাট রিজ। উৎসবমুখর পরিবেশে ‘বনের মাঝে লেখার খোঁজে’ স্লোগানে রকল্যান্ড রিট্রিট অ্যান্ড বুক ফেয়ার শুরু হয় গত ২৯ জুলাই শনিবার। প্রবাস প্রজন্মে বাংলা সংস্কৃতির ফল্গুধারা প্রবাহিত করতে সকলে একযোগে কাজের সংকল্প ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে দু’দিনব্যাপী সফল সাহিত্যানুষ্ঠান ও বইমেলা শেষ হয় ৩০ জুলাই রোববার রাতে।
৩০ জুলাই ১ম দিন আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে সকালে ছিল বনের মাঝে হাঁটা, ইয়োগা এবং সাঁতারকাঁটা। এখানে ছিলো ক্যাম্পিংয়ের ব্যবস্থাও।
সুবিশাল তাবুর নিচে সুসজ্জিত মিলনায়তনে বিপুল সংখ্যক লোকের উপস্থিতিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমেরিকান ইংরেজী ভাষার সঙ্গীত শিল্পীরা বাংলায় “আমার সোনার বাংলা”- জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করেন দারুণভাবে।
অনুষ্ঠানের আয়োজক বেঙ্গলি ইন্টারন্যাশনাল লিটারেরি সোসাইটি’র প্রতিষ্ঠা সভাপতি বিজ্ঞানী ও ছড়াকার ড. ধনঞ্জয় সাহা এবং ইভেন্ট কমিটির আহবায়ক বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব কানাডা’র সভাপতি কবি, আবৃত্তিশিল্পী ও সংগঠক মৌ মধুবন্তী স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে অনূষ্ঠানের সূচনা করেন।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব কানাডা’র সচিব, শিক্ষক ও লেখক মানসী সাহা।
রিবন কেটে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন প্রতিবন্ধী স্কুল অট্রো স্পীচট স্কুল এর প্রতিষ্ঠাতা এবং ডাইরেক্টর জ্যানেট রড্রিগেজ।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশের জাতিসত্তার কবি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা এবং বিশেষ অতিথি ভারত থেকে সমাজ সচেতন নারীবাদী কবি সুবোধ সরকার যুক্ত হয়েছিলেন অনলাইনে।
জুমে রাইটিং ফ্রম দি রিডার্স পার্সপ্যাক্টিভের উপর বক্তব্য রেখেছিলেন নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে প্রফেসর ড. জর্জ গোপেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন সাউথ ক্যারোলাইনা থেকে নিউরোসাইকোলজিস্ট, অথার ও পাবলিশার ড. হাওয়ার্ড র্যানকিন। তার বিষয় ছিল হাউ নট টু থিঙ্ক অ্যান্ড রাইট ইফেক্টিভলী।
এছাড়াও কবিদের স্বরচিত কবিতা ও গল্প পাঠে অংশ নেন কবি বেনজির শিকদার, বিমল সরকার, মৌ মধুবন্তী, সবিতা দাস সুতার, মোহাম্মাদ মিজানুর রহমান, শহিদ রাজু, বিদিয়া মুরলীধর, কুলসুম আক্তার সুমী, বনানী সিনহা, গ্যালিলি ডেমাইও, মুনমুন সাহা, নবনীতা দিমিত্রা, হাওয়ার্ডব্ল্যাঙ্কিন, উইলিয়াম টাইলার প্রমুখ। প্রথম দিনের লোকালি গ্রোন বায়োডিনামিক প্রোডিউস দিয়ে ডিনার ছিল অতুলনীয়।
দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানটি ভরপুর ছিল অনবদ্য চিন্তাধারার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। সকালে আবারো অর্গানিক ব্র্যাকফাস্ট দিয়ে দিন শুরু হয় দিনব্যাপি কর্মসূচি। থ্রী ফোল্ড ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর এরিকসিলবার এবং অনুষ্ঠানের আয়োজক ড. ধনঞ্জয় সাহা ও আহবায়ক মৌমধুবন্তী তাদের স্বাগত বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠান শুরু করেন।
বহ্নিশিখা গ্রুপের ক্ষুদে শিল্পীরাজেরা বাংলাদেশ ও আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে শোনায়। ড. অনিমিতা সাহা বাংলা জাতীয় সঙ্গীত ও অন্যান্য কিছু বাংলাগানের অনুবাদ করেছেন ইংরেজী ভাষার দর্শকদের জন্যে।
অতিথিদের থাকার সুব্যবস্থা ছিল সভাস্থল সংলগ্ন হোল্ডিং হাউজে। থাকা খাওয়া ছিল রেজিস্ট্রেশন ফিয়ের মধ্যেই। প্রোগ্রামের সুবিধার্থে ইভেন্ট ব্রাইটে রেজিষ্ট্রেশনের ব্যবস্থা ছিল। তার থেকে ৫০ ডলারের কূপন দেয়া হয় রেজিষ্টার্ড অংশগ্রহণকারীদেরকে বই ও অটিস্টিক নারী-পুরুষের তৈরি ক্রেফট কেনার জন্য।
নিউইয়র্কে এই প্রথম রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়ে সাহিত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে একটা দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছে বেঙ্গলি ইন্টারন্যাশনাল লিটারারী সোসাইটি।
একুশ বছরের উর্ধে অটিস্টিক যুবক-যুবতীর জন্য শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান এন্ডেভার ২১+ এর অটিস্টিক শিক্ষার্থীদের লেখা কবিতা পাঠের আসর ছিলো সংবেদনশীল। যার নেতৃত্ব দেন গ্যালিলি ডেমাও। মালবেরি স্থানীয় ব্যান্ডের (গ্যালিলি, নাটালি, জেনি, লেলিয়ানা ও জন) ইংরেজী গান ছিলো বেশ মনোমুগ্ধকর। স্প্যানিশ কবি ড্যানিয়েলার ইংরেজী ও স্প্যানিশ কবিতা পাঠ শুনে সবাই মুগ্ধ হন। গৌতম সাহার রচিত এবং তার কণ্ঠে বাংলা গানের সাথে ইংরেজী ও স্প্যানিশ গানের মেলডি ছিলো অনবদ্য।
ইউরিথিমি স্কুলের শিক্ষক এলসা মেককউলি নিপূনভাবে দেখিয়েছেন বাংলা এবং ইংরেজি শব্দ এবং বাক্যের দেহ সঞ্চালনা যেটা চিক্তিসামূলক।
মোহাম্মাদ নাসির শিকদার আলোকপাত করেন কি করে অভিসিটিমুক্ত হয়ে সুস্থভাবে মনোযোগ দিয়ে সাহিত্য চর্চা করা যায়। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন রিনা সাহা এবং অধ্যাপিকা হুসনে আরা।
মৌ মধুবন্তীর সঞ্চালনায় নির্দিষ্ট শব্দের ব্যবহারে মোট সাতজন কবি বনের মধ্যে বসে কবিতা লিখেছেন। এতে প্রথম পুরস্কার জিতে নেন বাংলাদেশ থেকে আগত সাংবাদিক, কবি শহিদ রাজু।
জলবায়ু সচেতন সংগঠক, লেখক ও পারফর্মারদের হাতে এওয়ার্ড, সার্টিফিকেট এর সাথে তুলে দিয়েছিলেন ড. ধনঞ্জয় সাহার নিজ হাতে লাগানো চোখ জুড়ানো গাছের চারা। দু’দিনের উপস্থিত লেখকেদেরকে উত্তরীয় পরিয়ে সম্মাননা জানানো হয়।
দ্বিতীয় দিনেও টি ব্রেকে ও লাঞ্চে থ্রি ফোল্ড ক্যাফের কুক জেসির হাতের আমেরিকান খাবার ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু। এর সাথে উত্তম সাহা যোগ করেন বাংলাদেশী চিকেন বিরিয়ানী ও সেদ্ধ ডিম। অভাবনীয় এক ফিউশান লাঞ্চে সবাই পরিতৃপ্তি নিয়ে আপ্যায়িত হন।
এই খাবারের দর্শন ছিল স্বামী বিবেকানন্দের দর্শনের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ। যার উপরে বক্তব্য রেখেছিলেন স্বামী সুমনাসানন্দা মহারাজ। এই পর্ব পরিচালনা করেন বিবেকানন্দ স্টাডি এন্ড ফিলান্থ্রোপিক সোসাইটির কর্ণধার প্রকাশ চক্রবর্তী। দর্শনটি ছিল বডি, মাইন্ড এন্ড স্পিরিট - বিষয়টি সম্পৃক্ত ছিল দার্শনিক ও কবি রুডলফস্টেইনারের দর্শনের সাথে।
অনুষ্ঠানে দুইদিনই সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী সামিনা খন্দকার। ক্লোজিং সেরিমোনিতে বাংলা গানের স্কুল বহ্নিশিখা থেকে নতুন প্রজন্মের শিশু, কিশোররা শিল্পী সবিতা দাস সুতারের তত্ত্বাবধানে তাদের সুললিত কণ্ঠে গান, আবৃত্তি পরিবেশন করে।
দুইদিনই বইয়ের স্টল বিশেষভাবে এক ঘন্টা করে ওপেন রাখা হয়েছিল ক্রেতাদের জন্য শুধু বই কেনা ও সিগ্নেচারের জন্য। মোট সতের জন কবি-লেখকের বই ছিল স্টলগুলোতে। কালের চিঠি প্রকাশনার স্টলও ছিল। এই বইমেলায় দু’শর অধিক বই বিক্রি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
কালের চিঠির প্রকাশক বিমল সরকার পরিচয় করিয়ে দেন তার গ্লোবাল ভিলেজ অয়েলফেয়ার গ্রুপকে।
রবিবার অনুষ্ঠান শেষে আরো একধাপ অনুষ্ঠান হয় ড. ধনঞ্জয় সাহার বাড়িতে বারবিকিউর মাধ্যমে। এই পর্বে কবি-সাহিত্রিকররা ছাড়াও সপরিবারে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্ক স্টেট আওয়ামীলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবর রহমান মিয়া। এই বারবিকিউর সমস্ত আয়োজন করেছিলেন উত্তম সাহা ও মুনমুন সাহা।
নবীন এবং প্রবীণ লেখকদের লেখায় উৎসাহ যোগানো, তাদের লেখা প্রকাশকরার মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেয়া এই প্রতিষ্ঠানের মুল উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা। বাঙালি সংস্কৃতির সাথে নতুন প্রজন্মকে জড়িয়ে রাখার ক্ষেত্রে এই মেলার গুরূত্ব অপরিসীম বলেও অনেকে মন্তব্য করেন।
২৩০ একর জমির উপর গড়ে ওঠা চেস্টনাট রিজের এই কমিউনিটির লোকেদের আন্তরিক সহযোগিতাও ছিল ব্যতিক্রমী। নানা ভাষাভাষীর বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশ নেন দু’দিনের এ অনুষ্ঠানমালায়।