নিউইয়র্কে শিশুদের দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলহাম একাডেমির ‘ফেইথ অ্যান্ড নলেজ’ (ভিডিও সহ)

নিউজ২৪ইউএসএ.কম ডেস্ক, নিউইয়র্ক : প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে প্রায় অবিশ্বাস্য গতিতে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে নিউইয়র্কে শিশুদের দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলহাম একাডেমি। বিশ্বমানের পাঠদানের পাশাপাশি নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। সেই ধারাবাহিকতায় এবার এলহাম একাডেমির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বার্ষিক আয়োজন ‘ফেইথ অ্যান্ড নলেজ’। আড়ম্বর এই অনুষ্ঠান পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশি কমিউনিটির মিলনমেলায়।
১৫ ডিসেম্বর জ্যামাইকার হিলসাইড এভিনিউর আল আকসা হলে এই মিলনমেলা বসে। অবশ্য পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল এলহাম একাডেমির শিক্ষার্থীদের ঘিরে। তারা অনুপ্রেরণামূলক বিভিন্ন ধরনের ইসলামি পারফরম্যান্সে অংশগ্রহণ করেছে। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন এলহাম একাডেমির কোরআন ও ইসলামিক স্টাডিজের ইন্সট্রাক্টর শেখ জুনায়েদ আহমদ।
ফেইথ অ্যান্ড নলেজ অনুষ্ঠানে শিশু শিক্ষার্থীদের সুললিত কণ্ঠের কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ হন উপস্থিত মেহমানরা। এছাড়া শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছে ইসলামি সংগীতের আয়োজনে। ছিল উপস্থিত বক্তৃতা, অভিজ্ঞতা বিনিময়সহ আরও অনেক কিছু। তারা ক্লাসওয়াইজ পারফরম্যান্সে অংশ নেয়, যার মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয় মুসলিম জাতির ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি।
এলহাম একাডেমির শিক্ষার্থী মারিয়াম আদিবা মাসুদ মাত্র ৭ বছর বয়সেই পুরো কোরআন হেফজ করে আলোড়ন তোলেন। কীভাবে এই সাফল্য অর্জন করলেন তিনি, সেই অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করেছেন ফেইথ অ্যান্ড নলেজ অনুষ্ঠানে। এসব বক্তৃতা ছাড়াও আরও নানা পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের হাতে সার্টিফিকেটসহ পুরস্কার তুলে দেন অতিথিরা। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ছবি তুলতে দেখা যায় সবাইকে।
ফেইথ এন্ড নলেজ নামের অনুষ্ঠানটিতে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ফাতিমা মাসুদ ও প্রচারক মস। এলহাম একাডেমির বিষয়ে জানাতে গিয়ে তারা বলেন, একটি শিশুর সামগ্রিক বিকাশকে নিশ্চিত করতে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক শিক্ষার ব্যতিক্রমী সংমিশ্রন নিয়ে হাজির হয়েছে ইলহাম একাডেমি। শুধু একাডেমিক শ্রেষ্ঠত্ব নয়, শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের ইহকাল এবং পরকাল উভয় ক্ষেত্রেই সাফল্যের সিঁড়ি মাড়াতে পারে, সেই লক্ষ্য নিয়ে পাঠ্যক্রম সাজিয়েছে এলহাম একাডেমি কর্তৃপক্ষ।
অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কের অ্যাসেম্বলিম্যান ডেভিড উইপ্রিন এলহাম একাডেমির ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরে নিউইয়র্কে স্টেটের সাইটেশন তুলে দেন প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল শাহানা ওয়ালিদের হাতে। ডেভিড উইপ্রিন বলেন, ইসলামি শিক্ষার আলোকে পরিচালিত হলেও ইলহাম একাডেমির পরিবেশ সকল বর্ণ ও ধর্মের মানুষের জন্য সহায়ক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। নিউইয়র্ক সিটি যে মাল্টিকালচারাল আবহকে ছড়িয়ে দিতে চায়, ইলহাম একাডেমিও সেটাকে ধারণ করে। এজন্য আমরা প্রতিষ্ঠানটির নেপথ্যে থাকা সকলকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
গভর্নর হোকুলের মুসলিম-আমেরিকান অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক মামাদৌ সিরে বাহ উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্বে দক্ষতা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। আবার দক্ষতা থাকলেও কোনো লাভ নেই, যদি ওই মানুষের চরিত্রে স্খলন থাকে। একটি শিশু যেন সমানতালে এই দুটোই অর্জন করতে পারে, সেই চেষ্টা করে যাক ইলহাম একাডেমি—এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এলহাম একাডেমির শিক্ষার্থীরা কতটুকু এগিয়ে, তা বুঝা যায় ‘আই এম দ্য ফিউচার’ নামক বইয়ের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানে বইটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। কেজি থেকে শুরু করে সিক্স গ্রেডের শিশু শিক্ষার্থীদের লেখা দিয়ে বইটি সাজানো হয়েছে। এত ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের লেখা দেখে বিস্মিত হয়েছেন অতিথিরা। তারা এলহাম একাডেমির এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জ্যামাইকা মুসলিম সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ড. ইমরান হোসাইন, মসজিদে কোবার প্রেসিডেন্ট সেলিম খান, দারুস সালাম মসজিদের ইমাম আবদুল মুকিত, জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের ইমাম মির্জা আবু জাফর বেগ, বাংলাদেশি আমেরিকান অ্যাডভোকেসি গ্রুপের প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন।
আরও উপস্থিত ছিলেন জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার, আল মামুর স্কুলের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মহসিন পাটোয়ারী, আল মামুর স্কুলের পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার নাসির উদ্দিন, দারুল হিকমাহ মসজিদের প্রেসিডেন্ট শাহাদাৎ খানসহ আরও অনেকে।
ফেইথ এন্ড নলেজ অনুষ্ঠানের গুরুত্ব কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বখ্যাত কারি ও দারুল ইসলাহ মসজিদ অ্যান্ড স্কুলের প্রিন্সিপাল শায়েখ ওয়ালিদ আল বেটরাইউশের উপস্থিতি। সিনিয়র সাংবাদিকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাপ্তাহিক নবযুগ সম্পাদক শাহাব উদ্দিন সাগর ও সাপ্তাহিক সাদাকালোর সম্পাদক আবুল কাশেম। এছাড়া আরও উপস্থিত ছিলেন হলিস মুসলিম কমিউনিটি সেন্টারের বোর্ড মেম্বার জসিম উদ্দিন।
সুন্দর আয়োজনের জন্য এলহাম একাডেমি কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে জ্যামাইকা মুসলিম সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ড. ইমরান হোসাইন বলেন, সদা পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ, যোগ্য, সৎ ও সাহসী মানুষের প্রয়োজন। সেই প্রয়োজন মেটানোর মহান ব্রত নিয়ে জ্যামাইকায় আধুনিক জ্ঞানের সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের অপূর্ব সমন্বয় করে শুরু হয়েছে এলহাম একাডেমির যাত্রা। আমরা মনেপ্রাণে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাফল্য কামনা করি।
মসজিদে কোবার প্রেসিডেন্ট সেলিম খান বলেন, বাংলাদেশি কমিউনিটিতে অল্প সময়ের মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে ইলহাম একাডেমি। সাফল্যের ধারাবাহিকতায় এবার বার্ষিক অনুষ্ঠান ফেইথ এন্ড নলেজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দোয়া করি, কোনো এক সময় সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে এলহাম একাডেমির নাম।
জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের ইমাম মির্জা আবু জাফর বেগ জানান, এলহাম একাডেমির পাঠ্যক্রমে দৈনন্দিন শিক্ষার সাথে ইসলামি শিক্ষা এবং মূল্যবোধকে এমনভাবে একীভূত করা হয়েছে যে, শিক্ষার্থীরা চাইলেও সেটা এড়িয়ে যেতে পারবে না। ইলহাম একাডেমি চায়, ইসলামের সাথে গভীর সংযোগ গড়ে উঠুক প্রতিটি শিক্ষার্থীর। তাই ইসলামি শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই সিলেবাস সাজানো হয়েছে। আশাকরি, এলহাম একাডেমি তাদের দুর্বার এগিয়ে চলা ধরে রাখতে সক্ষম হবে।
এলহাম একাডেমির বোর্ড অব ডিরেক্টরের চেয়ারম্যান ও কমিউনিটি লিডার মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, কলা ও গণিত—ভালো ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো সবসময়ই মূখ্য ভূমিকা পালন করে। ইলহাম একাডেমি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছে এই পাঁচ বিষয়ের ওপর। দ্রুত বিকশিত বিশ্বে ভবিষ্যতের ক্যারিয়ারের জন্য প্রস্তুত করতে শিক্ষার্থীদের নার্সিং করা হচ্ছে। পাঠদানের ক্ষেত্রে ইলহাম একাডেমি হাতে-কলমে শিক্ষা এবং বিশ্বের আজকের বাস্তবতার ওপর জোর দেয়।
তিনি আরও বলেন, পরবর্তী প্রজন্মকে আদর্শিক ও সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে নিউইয়র্কে স্টেট যেসব স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করেছে, সেগুলোর ওপর নজর রেখে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে ইলহাম একাডেমি। প্রতিটি শিক্ষার্থী যাতে মানসম্মত শিক্ষা পায়, সেজন্য উচ্চ শিক্ষিত এবং বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা ক্লাস পরিচালনা করে থাকেন। শিক্ষার্থীরা যাতে আনন্দ নিয়ে শিখতে পারে, সেজন্য ক্লাসগুলো তুলনামূলকভাবে অল্প সময়ের মধ্যে শেষ করা হচ্ছে।
জ্যামাইকা বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ফখরুল ইসলাম দেলোয়ার এলহাম একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার হাত দিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছে, সেটা একদিন ছড়িয়ে পড়বে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে। আমরা, বাংলাদেশি কমিউনিটি এমন ভালো উদ্যোগে সবসময় আপনার পাশে আছি।
আল মামুর স্কুলের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মহসিন পাটোয়ারী বলেন, নিউইয়র্কবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এটা খুবই আনন্দের ব্যাপার যে, ইলহাম একাডেমির মতো একটা প্রতিষ্ঠান এখানে আছে। আশাকরি স্কুলটির কর্তৃপক্ষ নবীন শিক্ষার্থীদের এমনভাবে গড়ে তুলবে, যাতে তারা ব্যক্তিজীবনে সমস্ত খারাপ জিনিস থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে।
সাপ্তাহিক নবযুগ সম্পাদক শাহাব উদ্দিন সাগর বলেন, যখন মুসলিম আমেরিকান যুবকরা তাদের পরিচয়, বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে, তখন আমাদের সামনে আছে এলহাম একাডেমি। এই প্রতিষ্ঠান তরুণদের মধ্যে একাডেমিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অসাম্প্রদায়িক চাহিদা পূরণের প্রতিশ্রুতি দেয়, যাতে তারা আগামী প্রজন্মের মধ্যে একটি শক্তিশালী ইসলামিক পরিচয় গড়ে তুলতে পারে।
ফেইথ অ্যান্ড নলেজ অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করেন বিশ্বখ্যাত কারি ও দারুল ইসলাহ মসজিদ অ্যান্ড স্কুলের প্রিন্সিপাল শায়েখ ওয়ালিদ আল বেটরাইউশ। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, আইটিভি ইউএসএ-এর মাধ্যমে আমেরিকার মাটিতে কোরআনের খেদমত হচ্ছে। তাদেরই উদ্যোগে চলছে এলহাম একাডেমি। এই সমাজে আমরা যখন নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছি, তখন বাচ্চাদেরও সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তৈরি করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এলহাম একাডেমি।
হলিস মুসলিম কমিউনিটি সেন্টারের বোর্ড মেম্বার জসিম উদ্দিন বলেন, নিউইয়র্কের মতো বৈচিত্র্যময় শহরে আমাদের শিশু কিশোর ও তরুণদের গাইড করার জন্য এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান খুবই দরকার ছিল। ইলহাম একাডেমি ঠিকঠাকভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারলে আমরা আমাদের শিশুদের ভবিষ্যত নিয়ে অনেকটাই নিশ্চিত হতে পারবো। আশাকরি, আমাদের শিশুরা বড় হয়ে উঠবে ইসলামি মূলনীতির আলোকে তৈরি নৈতিকতার মাধ্যমে।