সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : আমাদের এই সময়ে, অর্থাৎ একুশ শতকের তৃতীয়-চতুর্থ দশকে, মুদ্রিত সংবাদপত্র তার অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারবে কি না, নাকি সব মুদ্রিত সংবাদপত্র টিকে থাকার জন্য অনলাইন পোর্টালে রূপান্তরিত হবে- এ রকম একটি উদ্বেগ সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে দেখা দিচ্ছে। এ উদ্বেগটি অপ্রকৃত নয়, কারণ মুদ্রিত সংবাদপত্র এখন অনেক বেশি ব্যয়বহুল। কাগজের দাম বেড়েছে; সংবাদপত্র ছাপাতে, সারা দেশে সেগুলো পাঠকের কাছে পৌঁছাতে এখন অনেক বেশি অর্থের প্রয়োজন। আমাদের দেশের কয়টি সংবাদপত্র ওয়েজবোর্ডের সিদ্ধান্ত মেনে তাদের সাংবাদিক ও সংবাদকর্মীদের বেতন দেয়, জানি না, যদি দেয় তাহলে তাদের বেতনভাতার পেছনে বেশ বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়। না দিলেও এ খরচের পরিমাণ নেহাৎ কম নয়। এখন মুদ্রিত সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন ছাপানোর পরিবর্তে দৃশ্যমাধ্যমে, সমাজমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়াটা যে কোনো পণ্য উৎপাদনকারী বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য অনেক বেশি সাশ্রয়ী এবং কার্যকর, যেহেতু অসংখ্য মানুষের কাছে সেসব বিজ্ঞাপন চলে যায়। এজন্য সংবাদপত্র এখন বিজ্ঞাপন সংকটে পড়েছে। সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়ার জন্য সংবাদপত্রকে এর সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় এবং মতামত কলামগুলোয় সরকারের সমালোচনা একটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় রাখতে হয়। তাতে অবশ্য সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অনেকটাই ক্ষুণ হয়। তার পরও সব সংবাদপত্র সরকারি বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয় সহায়তা পায় না।
অনলাইন সংবাদপত্রের সুবিধা বা প্রলোভন আরও আছে।
এগুলোর মধ্যে প্রধান কয়েকটি হচ্ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাজা খবর বা ব্রেকিং নিউজ সংযুক্ত করার সুযোগ; যে কোনো সংবাদ বা মতামত কলাম বিস্তৃত পরিসরে প্রকাশ করার সুযোগ, যেখানে শব্দসংখ্যার কোনো সীমা টানার প্রয়োজন হয় না; বহুমাত্রিক করতে পারে, এবং যে কোনো সংবাদ, সংবাদ বিশ্লেষণ বা মতামত কলামের নিচে পাঠকের নিজস্ব অভিমত তুলে ধরার সুযোগ। এর কোনোটিই মুদ্রিত সংবাদপত্র করতে পারে না। দৃশ্যমাধ্যম ও ডিজিটাল প্রযুক্তির এ যুগটিকে বলা হয় চমকের যুগ। চমক অর্থ শুধু চটকদার প্রভাব সৃষ্টি করা ছবি, গান, কথা বা ঘটনাই নয়; চমকের একটা বস্তুগত দিকও আছে। চমক সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। আবার যেখানে বিনিয়োগ যত বড়, সেখানে পুঁজির ভূমিকাও তত বেশি। এজন্য দৃশ্যমাধ্যমে চমক সৃষ্টি করে যতগুলো প্রতিষ্ঠান, সংগঠন অথবা শক্তি যেমন সমাজমাধ্যমের জনপ্রিয় সাইট বা হ্যান্ডলগুলোসহ ভিডিও শেয়ারিংয়ের নানা প্ল্যাটফরম (ইউটিউব, টিকটক)- এদের প্রতিটির পেছনে বিনিয়োগ শত শত কোটি ডলার। এ চমকের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। ওপরে বর্ণিত চমকের সবই উৎপাদক ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সংস্কৃতিতেও বড় প্রভাব রেখেছে। সে প্রভাব কতটা ইতিবাচক, কতটা নেতিবাচক সেই বিতর্ক চলতে পারে, কিন্তু মোট কথা হচ্ছে, এদের কারণে পড়ার প্রতি আমাদের শিক্ষার্থীদের মনোযোগ কমেছে, বেড়েছে দেখার প্রতি। সংবাদপত্রকে এ চমকের জগৎও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এমনকি সংবাদপ্রধান টিভি চ্যানেলগুলোও এখন সংবাদপত্রের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এগিয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন সংকটে এবং অনলাইন পোর্টালে সংবাদপত্রের নানা সুবিধার কারণে পশ্চিমের অনেক দেশেও সংবাপদপত্র শিল্পে একটা মন্দার অবস্থা তৈরি হয়েছে। অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক সংবাদপত্র অনলাইনে আশ্রয় নিয়েছে, অনেকটি মুদ্রিত সংস্করণের পাশাপাশি অনলাইনেও ছাপা হচ্ছে, নিউইয়র্কের প্রভাবশালী ও বনেদি সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস, যা প্রথম ছাপা হয় ১৮৫১ সালে, দেড় শ বছর পরে এসে প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন ছাপে ২০০৯ সালে। এর কারণ অর্থ সংকট। অর্থের জোগান দিতে পত্রিকাটি তার মালিকানায় থাকা দালানটিও বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে শুধু ওয়াশিংটন পোস্ট ছাড়া সব কাগজই এখন প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন ছাপে, ওই কাগজটি তা পারে কারণ এটি চালায় এক শিক্ষাসম্পর্কিত কোম্পানি, যাদের অর্থের সংকট নেই। আমাদের দেশে এখন মাঝে মাঝেই বড় কাগজগুলো প্রথম পৃষ্ঠাসহ দুই, তিন বা পুরো চার পৃষ্ঠাই কোনো বিজ্ঞাপনের জন্য ছেড়ে দেয়। পাঠক কাগজটি হাতে নিয়েই ধাক্কা খান। প্রথম পৃষ্ঠা জুড়েই বিজ্ঞাপন, যার ওপরে এক কোনায় লেখা থাকে ‘পাতা ওল্টালেই মূল কাগজ’! এটি হচ্ছে কারণ ওই এক দিনের বিজ্ঞাপন থেকে পাওয়া আয় দিয়ে হয়তো কয়েকদিন নিশ্চিন্তে কাগজটি চালানো যায়। তবে বেশির ভাগ সংবাদপত্রের মুদ্রিত কাগজের সঙ্গে অনলাইন সংস্করণও প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে একটা ভারসাম্য তৈরি হয়েছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে, একদিকে যেমন প্রতি সকালে চায়ের টেবিলে মুদ্রিত কাগজটি পৌঁছে যাচ্ছে, অন্যদিকে অনলাইন সংস্করণে যখন খুশি কাগজটা পড়া যাচ্ছে। যাতায়াতের সুবিধার জন্য এখন সারা দেশে দিনের কাগজ সাধারণত দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে যাচ্ছে। সিলেটে, বরিশালে, রাজশাহীতে, কক্সবাজারে আমি ঢাকার কাগজ সকালের চায়ের সঙ্গে পড়েছি।
মুদ্রিত সংবাদপত্রের সংকট হয়তো ভবিষ্যতে আরও বাড়বে, কিন্তু সেই সংকট যে এদের প্রকাশ বন্ধ করে দেবে, মুদ্রিত সংবাদপত্র জাদুঘরে স্থান নেবে, তেমন ভাবার কোনো কারণ এখনো তৈরি হয়নি। বিশ্বের জনবহুল দুটি দেশের পাশাপাশি আমাদের দেশ থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান অন্তত তা-ই বলে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউজপেপার ইন্ডাস্ট্রি স্টাটিসটিকস অ্যান্ড ফ্যাক্টস-২০২৩ অনুযায়ী ১২ কোটি ৪০ লাখ লোক প্রতি সপ্তাহে সংবাদমাধ্যমে খবর পড়ে, তার মধ্যে ৬০ শতাংশ খবরের কাগজ পায়। ভারতের স্টাটিস্টা গ্লোবাল কনজুমার সার্ভে জানাচ্ছে, ৫৪% শহুরে ভারতীয় খবরের কাগজ পড়ে। বাংলাদেশে এ ছবিটা অবশ্য অনেকটাই অনুজ্জ্বল। ২০২১ সালের ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভে অনুযায়ী ১৫ বছরের ঊর্ধ্বের জনগোষ্ঠী মাত্র ১৮.৩ শতাংশ প্রতিদিন খবরের কাগজ ধরে। তবে বাংলাদেশে শিক্ষিত এবং সংবাদপত্র কেনার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের হিসাবে এ সংখ্যাটি হতাশাজনক নয়। এটি প্রমাণ করে মুদ্রিত সংবাদপত্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখনো অটুট আছে। এটি প্রতি বছর বাড়বে কি না সে ভিন্ন প্রশ্ন। তা নির্ভর করছে অনেক বিষয়ের ওপর, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে সংবাদপত্র কত স্বাধীনভাবে, নির্ভয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে; কত শক্তি নিয়ে, বৈচিত্র্য আর নানাবিধ আকর্ষণ নিয়ে দৃশ্যমাধ্যমের মোকাবিলা করতে সক্ষম হচ্ছে এবং স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে সমানভাবে গৃহীত হচ্ছে- এ বিষয়গুলো। আমাদের দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মত প্রকাশের স্বাধীনতার মতোই কাগজে কলমে স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন কতটা, তা সবাই জানেন। সংবাদপত্রগুলোকে কাজ করতে হয় নানান আইনের, যেমন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা মাথায় রেখে। সংবাদপত্র যখন সত্য প্রকাশ করে, তখন তার পাঠক বাড়ে। আমাদের সমস্যা হলো, এ ক্ষেত্রে বাধা শুধু যে সরকারের নানা নিয়মকানুন থেকে আসে তা নয়, সংবাদপত্রের যারা মালিক, যারা দেখা যাচ্ছে বড় বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা গ্রুপ অব কোম্পানিজ; তাদের পছন্দ-অপছন্দও সংবাদপত্রগুলোকে বিবেচনায় রাখতে হয়। আর রাখতে হয় বড় বিজ্ঞাপনদাতাদের অখুশি না করার চর্চাটি। আমার মনে আছে একটি কাগজে এক বড় টেলিকম কোম্পানিকে সমালোচনা করে রিপোর্ট ছাপানোর পর ওই কাগজে কোম্পানিটি বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। বিজ্ঞাপন ছাড়া কোনো সংবাদপত্র চলে না। বস্তুত একটি পত্রিকা ছাপতে যে পয়সা লাগে, সে পত্রিকা বিক্রি করে তার অর্ধেকও হয়তো আসে না। বিজ্ঞাপন না পেলে কাগজ ছাপানোয় ক্ষতির পরিমাণ বেশি। এর বিপরীতে একটি সম্ভাবনা অবশ্য রয়েছে। একটি পত্রিকা জনপ্রিয় হলে, সত্যিকার পাঠকপ্রিয় হলে তাতে বিজ্ঞাপনের কমতি হয় না। আমাদের দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতে দেশের বাইরে থেকেও বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান, নির্মাতা ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে তাদের কোম্পানির অফিস খুলবে, ফ্যাক্টরি বসাবে- অর্থাৎ বাংলাদেশে দৃশ্যমান হবে। তখন বিজ্ঞাপনচিত্রে গতি আসবে।
খবরের কাগজকে প্রকৃত অর্থে বৈচিত্র্যময় ও আকর্ষণীয় হতে হবে। দৃশ্যমাধ্যমের যুগে এ আকর্ষণের একটা অনিবার্যতা আছে। ভারত-শ্রীলঙ্কা এবং পূর্ব এশিয়ার দু-একটি দেশে দেখেছি, সংবাদপত্রকে সত্যিকারভাবে আকর্ষণীয় করে গ্র্যাফিক ডিজাইন, কাগজ, ছাপা ইত্যাদি অর্থে- সকালে যখন নিউজস্ট্যান্ডে রাখা হয়, মানুষ হাত বাড়িয়ে সেগুলো কেনে। সংবাদপত্রের সাহিত্য সাময়িকী আপাতদৃষ্টে বাজে খরচ মনে হতে পারে, কিন্তু তা ওই কাগজের মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। যে পাঠকশ্রেণি সাহিত্য সাময়িকী পড়বে, তারা হয়তো বিনোদন বা লাইফস্টাইলে তেমন ঝুঁকবে না, কিন্তু কাগজের মান বাড়লে ওই শাখাগুলো যখন সমান আকর্ষণীয় হবে তখন মোট পাঠকসংখ্যা অবশ্যই বাড়বে। আমাকে যদি কেউ কয়েকটি কথায় সংবাদপত্রের টিকে থাকাটা কীভাবে সম্ভব প্রশ্নটির একটা উত্তর দিতে বলেন, আমি বলব, সাংবাদিকদের বেতনভাতা বাড়িয়ে- যা তাদের স্বচ্ছন্দে জীবনধারণ সম্ভব করে দেবে- সংবাদপত্রকে স্বাধীন হতে দিয়ে, তা করা সম্ভব। উত্তরটি হয়তো ইউটোপিয়ান শোনাবে, কিন্তু সেই লক্ষ্যে আমাদের এগোতে হবে। হয়তো আরও কুড়ি বছরে তা ইউটোপিয়ান থাকবে না, বাস্তবে পরিণত হবে।
২. সংবাদপত্র টিকে থাকবে কারণ এ দেশে ১০০ বছরে সংবাদপত্র একটি ব্যান্ডেড অবস্থানে চলে এসেছে, যে রকম আমাদের ট্রেন বা রেলওয়ে, গ্রামীণ মেলা, জামদানি শাড়ি, জব্বারের বলীখেলা ইত্যাদি ব্র্যান্ডেড হয়ে গেছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সংবাদপত্র যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে, এর পরে জাতীয় জীবনের নানা ক্রান্তিকালে এবং সকল সময়ে ওই ভূমিকাটি যে ধরে রেখেছে, তাতে সংবাদপত্র মানুষের কাছে একটি অনিবার্য উপস্থিতি। কোনো অনলাইন কাগজ বা টেলিভিশন চ্যানেল এভাবে ব্র্যান্ডেড হতে পারেনি। অনলাইন কাগজ এখনো মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি, সংবাদপত্র পেরেছে।
অনলাইন কাগজ পাঠকের সেই আগ্রহ ও নিষ্ঠা দাবি করতে পারেনি, যা সংবাদপত্র পেরেছে।
সংবাদপত্র এখনো আমাদের বাস্তবতার আয়না। এ ভূমিকা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।
লেখক : বরেণ্য শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্যসমালোচক। (বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে)