ইমা এলিস : যুক্তরাষ্ট্রে কসাই সংকটের ফলে কোরবানির মাংস পেতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোগান্তি দিন দিন বেড়েই চলছে। মাংস পেতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে হাজার হাজার প্রবাসীদের। তারা কেনা মাংস দিয়েই মেহমানদারি সারেন ঈদের দিন, আর 'কোরবানির মাংস' হাতে পান ঈদের ২/৩ দিন পর। যুগ যুগ ধরে কসাই সংকটের কারণে এ বিড়ম্বনায় দেখা দিলেও এ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে প্রবাসীদের কাছে।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৭ হাজার গরু ও ছাগল বা প্রাণিসম্পদ খামার রয়েছে। এসব খামারে দেওয়া কোরবানির অর্ডারের মাংস ঈদের ২/৩ দিন পর হাতে পান প্রবাসীরা। যুগ যুগ ধরে এ অবস্থা চলে আসছে কিন্ত তবুও নিরুপায় হয়েই প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের খামারে খামারে গিয়ে এ যৌথভাবে গরু এবং এককভাবে ছাগল কোরবানির অর্ডার দিচ্ছেন। প্রায় প্রতিটি খামারেই ঈদের দিন থেকে হাজার হাজার গরু-ছাগল জবাই করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ক্রমিক নম্বর অনুসারে কারও ভাগ্যে ঈদের দিন, আবার কারও ভাগ্যে ঈদের ২/৩ দিন পর জোটে কোরবানির মাংস। ঈদের দিনে কোরবানির মাংস হাতে পাওয়া প্রবাসীর সংখ্যা খুবই কম।
যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ শতাংশ প্রবাসী বাংলাদেশিরা এখানে যৌথভাবে গরু ও একক ভাবে ছাগল কুরবানিতে অংশ নেন। শুধু বাংলাদেশিরাই নয় যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমান ধর্মাবলম্বী সকল দেশীয় মানুষরাও পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে প্রায় এক মাস আগে থেকেই বিভিন্ন খামারে গিয়ে গরু-ছাগল ওজন দিয়ে কোরবানির জন্য অর্ডার দিয়ে আসেন। ঈদের দিনে নামাজ শেষেই বেশিরভাগ প্রবাসীরাই ছুটে যান খামারের উদ্দেশ্যে। সেখানে গিয়ে অপেক্ষার পর অপেক্ষা। সারাদিন অপেক্ষার পর কোরবানির গরু-ছাগল জবাইয়ের ক্রমিক নম্বর না মেলায় দিনান্তে ঘরে ফিরে আসেন। পরদিন আবার ছুটে যান একই খামারে। এভাবেই কোরবানির মাংসের জন্য চলে দৌঁড়ঝাপ।
জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক, ম্যাসাচুসেটস, নিউ জার্সি, ওয়াশিংটন ডিসি, ভার্জিনিয়া, ম্যারিল্যান্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, ফ্লোরিডা, জর্জিয়া, কানেকটিকাট, নর্থ ক্যারোলিনা, ওহাইও, মিনেসোটা, টেনেসি, নিউ হ্যাম্পশয়ার, মেইন, রোড আইল্যান্ড, ভারমন্ট অঙ্গরাজ্যের হাজার হাজার প্রবাসী বাংলাদেশিরা ঈদুল আজহার একমাস আগে থেকেই ছুটে যান বিভিন্ন গরুর খামারে। সেখানে জীবন্ত গরু যৌথভাবে এবং ছাগল এককভাবে ওজন দিয়ে কোরবানির অর্ডার বুকিং দিয়ে আসেন।
এদিকে, বিভিন্ন খামারে ছেদক ও কসাইয়ের হাতে বর্জ্যের নামে শত শত মণ কোরবানির মাংস চুরির ঘটনাও ঘটেছে অহরহ। ঈদের দিন এসব খামারে এক তৃতীয়াংশের বদলে দেড় বা দুই তৃতীয়াংশ গরুর বর্জ্য ফেলে দেয়ার ঘটনায় অবাক হয়েছেন প্রবাসী মুসলমানরা। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়, প্রতিবছরই ঘটে এমন ঘটনা। তবে এ ঘটনাকে সুকৌশলে কোরবানির মাংস চুরি বলে উল্লেখ করেছেন অনেকেই।
প্রকৃতপক্ষে বর্জ্যমুক্ত দুই তৃতীয়াংশ মাংস ঘরে আনার কথা। একটি গরুতে এত বর্জ্য ফেলাতে হয় না বলে জানিয়েছেন অভিজ্ঞ গ্রোসারী ব্যবসায়ীরা। নিউ ইয়র্কের একটি গ্রোসারিতে কর্মরত অভিজ্ঞ গরু ছেদক জানান, একটি গরু জবাইয়ের পর চামড়া, ভুঁড়ি ও পাসহ আনুষঙ্গিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাদ দিলেও প্রকৃত ওজনের এক তৃতীয়াংশ বর্জ্য ফেলে দিতে হয়।
কিন্ত অধিকাংশ খামারে এক তৃতীয়াংশ বর্জ্যের বদলে দেড় বা দুই তৃতীয়াংশ বর্জ্য ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। যা দেখে প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হতাশ হয়েছেন। এসব বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তার গরু দেরিতে বা না কাটার হুমকি দেন খামারিরা। এ কারণে কেউ জোর প্রতিবাদ করেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় খামারে ১৫ হাজার, মাঝারি ও ছোট মাঝারি খামারে ১ হাজার থেকে ৫ হাজার গরু পালন করা হয়। এসব খামার থেকে প্রতি বছর ৩৯ মিলিয়ন গরু জবাই করা হয়।যুক্তরাষ্ট্রে কোরবানির গরুতে একটি ভাগের মূল্য পড়ে প্রায় ২৫০ ডলার।
নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি তোফায়েল আহমেদ জানানা, তিনি গত ৮ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিত কোরবানি দিতেন। মাঝে কিছুদিন আর দেননি। গত বছর আবার তার বন্ধুদের সঙ্গে কোরবানির গরুতে একটি ভাগ দিয়েছিলেন। ১৫ দিন আগে একটি খামারে গিয়ে গরু ওজন দিয়েছিলেন ১৫শ ৬০ পাউন্ড। ঈদের দিনে বর্জ্য বাদ দিয়ে প্রকৃত মাংস পেয়েছেন মাত্র ৫শ ৬০ পাউন্ড। একটি গরুতে ১ হাজার পাউন্ড বর্জ্য ফেলে দিতে হয় এটা অবিশ্বাস্য যা তিনি কখনই দেখেননি বা শোনেননি। শুধু তাই নয় মাংস কাটার জন্য বিভিন্ন গ্রোসারিতেও চর্বি ফেলে দেয়ার নামেও নিয়মিত চুরি হয়ে যায় মাংস।
কানেকটিকাটের প্রবাসী হেমায়েত আলী জানান, অংশীদারদের সঙ্গে সময় মত ফার্মে যেতে না পারলে মনমালিন্য দেখা দেয়। আবার গরু কেটে নিয়ে আসার পর মাংস টুকরো করার আরেকটি ঝামেলা হয়। তাই তিনি নিউ ইয়র্ক থেকে নিয়মিত গ্রোসারি কিনে আনেন। ঈদের আগেও তিনি মাংস কিনে আনেন নিজেদের ঈদ সারেন। তবে প্রতিবছর কোরবানির জন্য দেশে আত্মীয় স্বজনদের কাছে টাকা পাঠান।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৩৭ হাজারেরও বেশি প্রাণিসম্পদ খামারে তীব্র কসাই ও ছেদক সংকট দেখা দেওয়ার ফলে ৩০ শতাংশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভাগ্যে ঈদের দিনে জোটে না 'কোরবানির মাংস'। কোরবানিতে অংশ নেওয়া প্রবাসীরা প্রাথমিকভাবে কেনা মাংস দিয়েই ঈদ উদযাপন করলেও ২/৩ দিন পর হাতে পান কোরবানির মাংস।